‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ শ্রমিকদের প্রতিস্থাপন করবে না, এক্সপার্টের মতামত

‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ শ্রমিকদের চাকরী খেয়ে ফেলবে, এমন ধারনা একটা মিথ্যা ধারনা। উদাহরণ হিসাবে মেশিনের (মেশিন বলতে এখানে কম্পিউটার বোঝানো হয়েছে) টিউমার খুঁজে বের করার কথা বলা যায়; ঐ কাজে মেশিন বোধ হয় রেডিওলজিস্টের চেয়ে বেশী দক্ষ। কিন্তু এমন হলে তো মেশিন রেডিওলজিস্টদের ভাত মেরে দিবে, রেডিওলজিস্টদের সংখ্যা কমে যাবে! আর টিউমারের চিকিৎসায় ডাক্তারদের ভূমিকাও খুব গৌণ হয়ে যাবে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সত্যি কথা হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রেডিওলজিস্টদের আজকের চেয়ে আরো নিখুঁতভাবে টিউমার সনাক্ত করতে সাহায্য করবে মাত্র। আর টিউমারের চিকিৎসায় ডাক্তাররা যে টিউমার খুঁজে বের করেন, সেটা টিউমারের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থায় খুবই ক্ষুদ্র একটা পার্ট। তাই এখনই খুব চিন্তার কিছু নেই। 

আমরা জানি যে মাইক্রোস্কোপ, ডিজিটাল ক্যামেরা, 3D প্রিন্টার ইত্যাদি টেকনোলজী/টুল আমাদের অনেক কাজকে সহজ করে দেয়। ঐসব টেকনোলজী/টুল ছাড়া নির্দিষ্ট ঐসব কাজ করতে গেলে আমাদের অনেক বেশী খোঁজাখুঁজি করা লাগত, নানান রকমের পদ্ধতি প্রয়োগের দরকার হত। একইভাবে, আজকের দিনে আমাদের অনেক রকমের কাজ সহজে করে ফেলার জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন একটা টুল মাত্র। তবে মনে রাখতে হবে, এইটা খুবই শক্তিশালী একটা টুল। আর প্রযুক্তির বদলে যাওয়া, নতুন প্রযুক্তির আগমন এইসব জিনিস হলিউডের মুভি কিংবা সাইন্স ফিকশন গল্পে যেভাবে দেখানো হয় তা আসলে অতিরিক্ত, অতিরঞ্জন। মোট কথা হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষকে আরো সক্ষম করবে তাদের কাজের ক্ষমতা বাড়িয়ে, কোন রকমের ক্ষতি করে নয়। 

এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর চারটি মূলনীতি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। সেগুলো হচ্ছেঃ

১) ক্ষমতা বাড়ানো এবং নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করাঃ

কোন সিস্টেমের জন্য এমনভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডিজাইন করতে হবে যেনো সেটা আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ায়, এবং যেহেতু সিস্টেম আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তাই এটা আমাদেরকে আত্নবিশ্বাস ও যোগাবে। এই পয়েন্টে এখন মানুষের বোঝা দরকার যে, নতুন এই টেকনোলজী কিভাবে ব্যাবহার করলে ভালো হবে এবং কিভাবে ব্যাবহার করলে সামনে বাজে কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।

উদাহরণ হিসাবে এপল এর হিউম্যান ইন্টারফেস গাইডলাইনের কথা আনা যায়। ওখানে বলা আছে, সিস্টেম ডিজাইনাররা যেনো এটা এনশিওর করেন যে এপ্লিকেশন না, এপ্লিকেশনের ইউজাররা কন্ট্রোলের মাঝে আছে! ধরা যাক, এল্ডার কেয়ার রোবট; যেগুলো সহানুভূতি, মমতা প্রদর্শন করতে পারে, এরা যদি কেয়ার গিভিং এর কাজে নিয়োজিত থাকতো তাহলে একটা আরোও ভালো একটা ডিজাইন বানানোর কথা চিন্তা করা যেতো। আরোও ভালো ঐ ডিজাইনের কারনে সিনিয়র সিটিজেনরা নিশ্চিতভাবে আরো স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারতেন এবং নিজের কর্মক্ষমতাও উপলব্ধি করতে পারতেন। এটা হলে রোবটের কেয়ার গিভিং সার্ভিস ডিজাইন করার ব্যাপারে আরো কিছু জিনিসও জড়িত থাকতে পারতো যেমন বয়স্ক মানুষদের যোগাযোগ করার ব্যাপার। এখানে এই যোগাযোগের বিস্তৃতি হতে পারে তাদের সাথে তাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, কেয়ার গিভার এমনকি ক্রমেই বেড়ে চলা অনলাইন কমিউনিটি পর্যন্ত।

২) সবাইকে সম্মান করা এবং সম্পর্ক তৈরী করাঃ

যেসব সিস্টেম মানুষের কথা ভেবে ডিজাইন করা হয়েছে সেগুলো রোবট-মানুষ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় না, বরং  মানুষের সাথে মানুষের বিশ্বাস, নির্ভরতা, যত্নবান একটা সম্পর্ক গড়ে তুলে। আর্টিফিশিয়ালী ইন্টেলিজেন্ট কোন ডিজাইন সমাজের ভালোর জন্য করা হয়। এ রকমের ডিজাইন নানান রকমের কাজ সমাধা করার জন্য ভালো একটা উপায়। এখন এই নানান রকমের কাজ অনেক কিছুই হতে পারে। যেমনঃ স্থানীয় সমস্যা বা জাতীয় রাজনীতিতে নজর দেয়া, স্টুডেন্ট বা কলিগদের পরামর্শ দেয়া, মানুষকে আরো বেশী ক্রিয়েটিভ করা ইত্যাদি।

৩) জবাবদিহিতা এবং গুণগত মান নিশ্চিত করাঃ

আর্টিফিশিয়ালী ইন্টেলিজেন্ট একটি ডিজাইন তার এপ্লিকেশনের কাজ এবং কাজের ফিডব্যাকের দিকে খেয়াল রাখে, সেগুলোর স্বচ্ছতার দিকে খেয়াল রাখে। যখন ঐ এপ্লিকেশনের কোন সমস্যা হয় তখন যেনো ইউজাররা তা বুঝতে পারে এবং এপ্লিকেশনের ডেভেলাপাররা ত্রুটি বের করে এপ্লিকেশনকে আরো উন্নত করতে পারে এমন একটা ব্যবস্থাও সেটাতে থাকে। উদাহরণ হিসাবে প্লেনের ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারের সুবিধাগুলোর কথা আনলে জিনিসটা সহজেই বুঝা যায়। ওটার মত করে সব রকমের অটোমেটেড সিস্টেমের এমন একটা রেকর্ডিং ডিভাইস থাকা উচিত যেনো কোন দরকার পড়লে সেই সিস্টেমের একটিভিটিজ ঐ রেকর্ডিং ডিভাইস থেকে এনালাইসিস করা যায়।

৪) ইউজারদের সিস্টেমের  অংশীদার করা এবং ডিজাইনকে আরো উন্নত করাঃ

প্রত্যেক ইউজার তার ইউজ করা টেকনোলজীর ইম্প্রুভমেন্ট এর জন্য যেনো সহযোগীতা করতে পারেন সেটার জন্য ইউজারকে আমন্ত্রণ করা উচিত, সুযোগ দেয়া উচিত। এই কথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা প্রোডাক্টের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রোডাক্টের সেইফটি এবং ইফেকটিভনেস বাড়ানো, এটাকে আরো ব্যবহার উপযোগী করার জন্য প্রোডাক্টের ইউজারদের মতামত পেতে ‘ক্রাউড সোর্সিং’ একটা মাধ্যম হতে পারে। একই সাথে, প্রোডাক্টের ইউজাররা ওয়েবসাইট এবং মোবাইল এপ’এ থেকে কিভাবে প্রোডাক্ট ইউজ করবেন সে ব্যাপারে যেনো গাইডলাইন পান, সেটা নিশ্চিত হওয়া উচিত। এতে করে ব্যবহারকারীরা তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তির ব্যাপারে ধারনা রাখতে পারবেন এবং প্রয়োজন অনুসারে ফিডব্যাকও দিতে পারবেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, স্বচ্ছতা আছে এমন ই-কমার্স সাইটগুলো প্রায়ই নানান রকমের প্রোডাক্ট কিনতে তাদের ভিজিটরদের উৎসাহিত করে। এইক্ষেত্রে তাদের উচিত হচ্ছে ঐসব প্রোডাক্টের ব্যাপারে তাদের ভিজিটরদের যৌক্তিক একটা ব্যাখ্যা দেয়া যে কেনো তারা ঐসব প্রোডাক্ট কিনতে ভিজিটরদের উৎসাহ দিচ্ছে। একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোও নির্দিষ্ট কিছু পোস্ট সবাইকে না দেখিয়ে কেনো শুধু নির্দিষ্ট কিছু ইউজারকেই দেখাচ্ছে, এই ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। একদম শেষের দিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডেভেলারপারদের লক্ষ্যের ব্যাপারেও কথা বলা যাক। তাদের উচিত হচ্ছে, নিয়মিতভাবে প্রোডাক্টের ফিডব্যাক নেয়া, ক্রমাগতভাবে প্রোডাক্টের অটোমেশনের কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং একই সাথে প্রোডাক্টের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা সুনিশ্চিত করা।

লেখকঃ বেন স্নেইডারম্যান,
প্রফেসর, কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্ট
ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড।

ফেইসবুক থেকে করা মন্তব্যসমূহঃ

%d bloggers like this: